বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আবারও বড় ধরনের পতনের মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত পাল্টা শুল্কারোপের জেরে বিশ্ববাণিজ্যে অনিশ্চয়তা বাড়ায় জ্বালানি তেলের দর এখন ৬০ ডলারের কাছাকাছি নেমে এসেছে- যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এতে বাংলাদেশ কম দামে তেল আমদানির সুযোগ পেলেও স্থানীয় বাজারে ভোক্তারা এখনও সেই সুবিধা পাচ্ছেন না।
গত কয়েক বছরে জ্বালানি তেলের দাম নানা চাপে ওঠানামা করেছে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় ব্রেন্ট ক্রুড ওয়েলের প্রতি ব্যারেলের দাম গড়ে ৪২ ডলারে নেমে আসে। পরের বছর সেটি বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭১ ডলারে।
এরপর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে দাম আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে- গড়ে ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায় এবং সর্বোচ্চ ১৩৯ ডলার পর্যন্ত উঠে। এতে বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি চরমে ওঠে। তবে ২০২৩ সালেই দাম কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং এখন ২০২৪ সালের প্রথম দিক থেকে তা ৭০ ডলারে নামার পর বর্তমানে ৬০ ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করছে।
বাংলাদেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ডিজেলের, যা কৃষি, পরিবহন ও শিল্প খাতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তাই তেলের দামের পরিবর্তন সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ের ব্যয়ের ওপর প্রভাব ফেলে।
২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ডিজেলের দাম ছিল ৬৫ টাকা লিটার। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়তেই ২০২২ সালের আগস্টে এক লাফে তা ১১৪ টাকায় উঠে যায়। পরে সমালোচনার মুখে ৫ টাকা কমিয়ে করা হয় ১০৯ টাকা।
বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ১০৫ টাকা, পেট্রল ১২২ এবং অকটেন ১২৬ টাকা নির্ধারণ করা আছে। সরকারের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থায় প্রতি মাসে নতুন দাম নির্ধারিত হওয়ার কথা থাকলেও গত দুই মাসে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
কেন দাম কমছে না?
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, তেল আমদানি করে দেশে আসতে সময় লাগে প্রায় এক মাস। ফলে বর্তমান দামের প্রভাব আগামী মাসে গিয়ে পড়ে। এছাড়া ডলারের দরবৃদ্ধিও অন্যতম বড় কারণ। ২০২২ সালে ১ ডলারের দাম যেখানে ৮৫ থেকে ১০৫ টাকার মধ্যে ছিল, এখন তা ১২২ টাকায় পৌঁছেছে। এতে আমদানি খরচও বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ডলারের মূল্য না বাড়ত, তাহলে বর্তমান বিশ্ববাজার অনুযায়ী লিটারপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত দাম কমানো যেত।
দেশে বছরে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন তেল ব্যবহার হয়, যার মধ্যে ডিজেলই প্রায় ৭৫ শতাংশ। অথচ চট্টগ্রামে থাকা একমাত্র তেল পরিশোধনাগারের সক্ষমতা মাত্র ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত তেল প্রক্রিয়াকরণ। এই পরিশোধনাগারটি তৈরি হয় ১৯৬৮ সালে। স্বাধীনতার পর আর কোনো নতুন শোধনাগার হয়নি।
বছরের পর বছর ধরে পরিশোধন ক্ষমতা বাড়ানোর প্রকল্পটি ঝুলে আছে অর্থায়ন জটিলতায়। কিছুদিন আগে বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলমকে প্রকল্পে যুক্ত করেছিল সরকার, তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এখন নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে সরকারি অর্থায়নে।
যেহেতু পরিশোধনাগারের সক্ষমতা কম, তাই দাম কমার সময়েও বেশি তেল আমদানির সুযোগ নেই। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন হলেও বাংলাদেশের ক্রয়ক্ষমতা এবং মজুত সীমাবদ্ধতার কারণে সেই সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগানো যায় না।
বিপিসি জানিয়েছে, দেশে পরিশোধন করা হলে প্রতি লিটার ডিজেলে ১৫ টাকার বেশি সাশ্রয় করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে পরিশোধিত তেল আমদানির ওপর নির্ভর করায় সেই সাশ্রয় সম্ভব হচ্ছে না।
২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জ্বালানি তেল বিক্রি করে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি। ২০২১-২২ অর্থবছরে তারা ২,৭০০ কোটি টাকার লোকসান করলেও পরের দুই বছরে গড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি লাভ করেছে। এর বাইরে সরকার প্রতিবছর জ্বালানি খাত থেকে ১৩ থেকে ১৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে।
সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) বলছে, আগের সরকার বিপিসির মুনাফাকে কেন্দ্র করে যে মূল্য নির্ধারণ সূত্র ঠিক করেছিল, সেটি ত্রুটিপূর্ণ। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজারভিত্তিক দামে চালানো হলে প্রতি লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা কমানো সম্ভব।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেও এখনো সেই পুরনো সূত্র অনুসারে দাম নির্ধারণ হচ্ছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও স্থানীয় বাজারে সেই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
এফপি/রাজ