সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার নরসিংপুর ইউনিয়নের চেলা নদীতে প্রকাশ্যে চলছে বালু লুটপাটের মহোৎসব। ইজারার বৈধতার দোহাই দিয়ে নদীর পাড় কেটে নির্বিচারে বালু উত্তোলনের ফলে প্রতিদিনই নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, ফসলি জমি ও সড়ক। স্থানীয়দের দাবি—এই লুটপাটে ইজারাদার, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের একটি অসাধু চক্র সরাসরি জড়িত।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলা প্রশাসন প্রতিবছর চেলা নদীর বালু ইজারা দিয়ে কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করলেও ইজারার শর্ত বাস্তবায়নে কার্যকর নজরদারি নেই। এর সুযোগ নিয়েই ইজারাদার সিন্ডিকেট নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নদীর পাড় ঘেঁষে, কোথাও আবার সরাসরি ফসলি জমি ও বসতঘরের পাশ থেকে বালু তুলে নিচ্ছে।
ইজারা নীতিমালা অনুযায়ী নদীর পাড় থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে এবং বিকেল ৪টার মধ্যে বালু উত্তোলনের নির্দেশনা থাকলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্থানীয়রা বলছেন সারপিনপাড়া, পূর্বচাইরগাঁও, সোনাপুর, রহিমের পাড়া, পূর্বসোনাপুর ও নাছিমপুর এলাকায় দিনের চেয়ে রাতের আঁধারে বালু উত্তোলন বেশি হচ্ছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে পাড় কাটার ফলে ইতোমধ্যে অন্তত অর্ধশত বসতঘর নদীতে বিলীন হয়েছে। শতাধিক পরিবার হারিয়েছে তাদের ভিটেমাটি, কয়েকশ একর ফসলি জমি পরিণত হয়েছে নদীগর্ভে। নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোর শেষ সীমানায় পাকা ঘরের অংশ ঝুলে থাকতে দেখা যাচ্ছে—যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি বড় গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে বিজিবি ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ‘ম্যানেজ’ করে এই বালু উত্তোলন চালিয়ে আসছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, নদীর পাড় কেটে বালু উত্তোলনের মাধ্যমে অন্তত ১০-১৫ জন ব্যক্তি কোটিপতি বনে গেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “নদীর পাড়েই বিজিবির টহল পোস্ট। তাদের চোখের সামনেই পাড় কেটে বালু লুট হচ্ছে। তারা কিছু বলছেনা। আমরা প্রতিবাদ করলেই হামলা-মামলার ভয় দেখানো হয়। বিচার চাইতে গেলে উল্টো হয়রানি হতে হয়।”
স্থানীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “নরসিংপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন মেম্বার ও পূর্ব চাইরগাঁও গ্রামের নুরুল ইসলাম নুরুর নেতৃত্বে এবং প্রশাসনের কিছু অসাধু লোকের সহযোগিতাতে নদীর পাড় কেটে বালু লুটপাট চলছে। অব্যাহত পাড় কাটার কারণে চেলা নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পুরো এলাকা মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।”
এ বিষয়ে জানতে জয়নাল আবেদীনের মোবাইল নাম্বারে কল দেওয়া হলে বন্ধ পাওয়া যায়। তবে নুরুল ইসলাম নুরু অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘অবৈধ বালু উত্তোলনের মতো নোংরা কাজে আমি জড়িত নই। আমার উপর মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে।’
দোয়ারাবাজার উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সামছুল হক নমু বলেন, “ইজারার বিরুদ্ধে নয়, নিয়মবহির্ভূত লুটপাটের বিরুদ্ধেই আমাদের আপত্তি। চেলা নদী একসময় মানুষের জীবিকার উৎস ছিল। সনাতন পদ্ধতিতে বালু উত্তোলন করলে নদী ও পরিবেশ দুটোই বাঁচত। কিন্তু একটি চক্র সব নিয়ম উপেক্ষা করে নদীকে ধ্বংস করেছে। ”
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের চেষ্টা হলে এলাকাবাসী তা প্রতিরোধ করে।
৪৮ বিজিবি'র সোনালী চেলা বিওপির ক্যাম্প কমান্ডার আবুল কাশেম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘চেলা নদীতে আমাদের সার্বক্ষণিক টহল রয়েছে। আন্তর্জাতিক সীমানায় এবং ইজারা বহির্ভূত সীমানায় বালু উত্তোলনের কোনো সুযোগই নেই। এসব জায়গায় অবৈধ বালু উত্তোলনে আমরা বাঁধা দেওয়ায় স্থানীয় কিছু লোকজন ফায়দা লুটতে না পেরে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
চেলা নদীর ইজারাদার টুটুল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘শ্রমিকরা তফসিল ঘোষিত জায়গা থেকেই বালু উত্তোলন করছে। ইজারা বহির্ভূত জায়গা থেকে বালু উত্তোলনের কোনো সুযোগই নেই।’
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অরুপ রতন সিংহ বলেন, “আমার কাছে দুই সপ্তাহ আগে একটা অভিযোগ এসেছিল। আমরা ইজারাদারকে সতর্ক করেছি এবং চেলা নদীতে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অভিযান চালিয়েছি। এছাড়াও ওইখানে বিজিবির টহল রয়েছে। এরপরও যদি ইজারাবহির্ভূত ভাবে পাড় কেটে বালু উত্তোলন করা হয় আমরা ইজারাদারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।”
এফপি/জেএস