গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির অবস্থা আশঙ্কাজনক। গুলিতে তাঁর মস্তিষ্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ফুসফুসেও আঘাত রয়েছে। তবে তাঁর কিডনির কার্যক্ষমতা গতকাল ফিরে এসেছে। স্বাস্থ্যের সার্বিক অবস্থার জন্য সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা বলেছেন চিকিৎসকরা। এদিকে ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পরও খুনিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। আসামি ধরতে সন্দেহভাজনের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুলের বাসাসহ অন্তত পাঁচটি জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। তাকে পাওয়া যায়নি। ফয়সাল একাধিক মোবাইল ফোন ও নম্বর ব্যবহার করছে। আসামি যাতে দেশের বাইরে যেতে না পারে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে হাদির চিকিৎসায় ১৪ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বোর্ডের প্রধান করা হয়েছে এভারকেয়ার হাসপাতালের আইসিইউ ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. জাফর ইকবালকে। মেডিক্যাল বোর্ডের বিবৃতিতে বলা হয়েছে- গুলিতে হাদির মস্তিষ্ক ‘মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে। শারীরিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হলে আবার ব্রেনের সিটি স্ক্যান করা হতে পারে। তাঁর ফুসফুসেও আঘাত রয়েছে। ফুসফুসে সংক্রমণ ও এআরডিএস (তীব্র শ্বাসকষ্ট সিন্ড্রোম- ফুসফুসের একটি গুরুতর অবস্থা) প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট অব্যাহত রাখা হবে। আশার কথা হচ্ছে, তাঁর কিডনির কার্যক্ষমতা ফিরে এসেছে। পূর্বে শরীরে রক্ত জমাট বাঁধা ও রক্তক্ষরণের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা (ডিআইসি) দেখা দিলেও তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যদিও মস্তিষ্কের নিচের অংশ বা গুরুমস্তিষ্কে আঘাতের (ব্রেন স্টেম ইনজুরি) কারণে অবস্থা অত্যন্ত সংবেদনশীল; রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের ওঠানামা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বোর্ডের সিদ্ধান্ত, হাদির শরীরে আপাতত কোনো অস্ত্রোপচার করা হবে না; পর্যবেক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা চলবে।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, গুলিবিদ্ধ হাদির পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হবে। মামলায় মোটরসাইকেল চালক ও তার পেছনে বসে যে গুলি করেছে, তাদের আসামি করা হবে। আসামি ধরতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে পুলিশ।
এদিকে হাদির ওপর সন্দেহভাজন হামলাকারীর ছবি প্রকাশ করে তার বিষয়ে তথ্য চেয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। গতকাল শনিবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ডিএমপি বলেছে- ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও বিশ্লেষণ করে এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। ওই ব্যক্তি সম্পর্কে কোনো তথ্য থাকলে বা তার সন্ধান পেলে দ্রুত পুলিশকে অবহিত করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া হামলাকারীকে ধরিয়ে দিতে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খানের নাম আসছে। এই ব্যক্তি কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সে সদস্য হয়েছিল। তার পুরো নাম ফয়সাল করিম দাউদ খান। ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারসহ বিভিন্ন জায়গায় তার সঙ্গে ফয়সাল করিমের সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ছবি রয়েছে। সেই ছবিগুলোতে থাকা ফয়সাল করিমের সঙ্গে গুলি করা ব্যক্তির চেহারার সাদৃশ্য থাকায় গুলি ছোড়ার ঘটনায় তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। লিংকডইন প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছে। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে এমবিএ করেছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৪ সালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে ফয়সাল করিম মাঠে ছিল। ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সাল করিম ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য (রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও গোলাম রাব্বানী নেতৃত্বাধীন কমিটি) ফয়সাল করিম দাউদ খান একই ব্যক্তি।
ওসমান হাদিকে সে বেশ কিছুদিন ধরে অনুসরণ করছিল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিমকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। পরে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পায় সে।
প্রসঙ্গত, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, রমনা ও শাহবাগ থানা এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন হাদি। সেজন্য প্রতি শুক্রবার তিনি জনসংযোগ করতেন। গত শুক্রবার দুপুরে মতিঝিলের একটি মসজিদে প্রচার শেষে সতীর্থদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের জন্য ব্যাটারিচালিত রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। পথে বক্স কালভার্ট এলাকায় একটি মোটরসাইকেলে এসে হাদির মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে পালিয়ে যায় খুনিরা।
এফপি/অ