জয়পুরহাটে নির্ধারিত দামেও বিক্রি হচ্ছে না আলু। কৃষকের লোকসান ঠেকাতে হিমাগারে আলুতে সরকারের দাম বেঁধে দেওয়ার পরেও ফল মিলছে না। হিমাগারের গেটে কেজি প্রতি নির্ধারিত ২২ টাকা দরে আলু বিক্রি হচ্ছে না। ফলে খুচরা বাজারেও এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা দরে। আর হিমাগার থেকে এখনো কেজিপ্রতি আলু কেনাবেচা হচ্ছে ১২ টাকা ১৪ টাকা দরে। এতে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
গত ২৭ আগস্ট কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তিতে হিমাগার থেকে ২২ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করার নির্দেশনা জারি করা হয়। যেখান থেকে একই দামে সরকারও ৫০ হাজার টন আলু কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। যা হিমাগারে সংরক্ষণ এবং আগামী অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বাজারে বিক্রি করা হবে। অপরদিকে, চলতি বছরের ১৫ নভেম্বরের মধ্যে হিমাগার থেকে আলু উত্তোলন না করলে সেই আলু নিয়ে বিপাকে পড়বেন হিমাগার কর্তৃপক্ষ, কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বীজের দাম বাড়ানোর জন্যই সরকার আলু কেজিপ্রতি ২২ টাকা নির্ধারণ করেছে। কেননা আলুর দাম বেঁধে না দিলে বীজ আলুর দামও কম হবে। এতে কোম্পানিদের অনেক টাকা লোকসান হবে। তাদের লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে এ দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
অথচ এ বছর এক কেজি আলু উৎপাদনে ১৬ থেকে ১৮ টাকা খরচ পড়েছে তাদের। আর হিমাগার পর্যন্ত আলু নেওয়ার জন্য পরিবহন ও শ্রমিকের পারিশ্রমিকের সঙ্গে হিমাগার ভাড়া যোগ করলে তা দাঁড়াবে ২৬ টাকা থেকে ২৮ টাকা। এমতাবস্থায় দেশের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি আলু উৎপাদন করা হয়েছে। হিমাগারের বাইরে যে পরিমাণ আলু বাজারে রয়েছে তা খেয়ে শেষ করতে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাস এসে পড়বে। আর মার্চে এসে পড়বে নতুন আলু। কাজেই আলুতে কৃষকের লোকসান পোষাতে হলে বিদেশে রপ্তানির বিকল্প নেই।
পাইকাররা বলছেন, বাজারে চাহিদা অনুযায়ী দাম না থাকায় সরকারের নির্ধারিত দামে আলু কেনাবেচা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে হিমাগার কর্তৃপক্ষ বলছেন, আলু মজুদ থাকলেও সরকারি দামে বাজারজাত করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তাই বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সরকারের বিকল্প কার্যকর পদক্ষেপ দরকার।
জয়পুরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ জেলার পাঁচ উপজেলায় ২০২৩-২৪ মৌসুমে ৩৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়েছিল। আবার ২০২৪-২৫ মৌসুমে হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে। যা গতবারের তুলনায় প্রায় ৫ হাজার হেক্টর বেশি। এতে আলু উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৬১ হাজার ৭৪ মেট্রিক টন। এছাড়া এ জেলায় ২১টি হিমাগার অবস্থিত। এরমধ্যে কালাই উপজেলায় ১৩টি হিমাগার অবস্থিত।
জেলার পাঁচ উপজেলায় হিমাগারে রাখা আলু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। সদর উপজেলার ধারকী সোটাহার গ্রামের কৃষক ফেরদৌস হোসেন বলেন, প্রায় ৬০ কেজির এক বস্তা আলু উৎপাদন খরচ ও ভাড়া মিলে দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় হাজার টাকা। অথচ বর্তমানে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৭২০ টাকায়। ফলে প্রতি বস্তায় গুনতে হচ্ছে অন্তত ৭৮০-৮০০ টাকা লোকসান।
কালাই উপজেলার পুনটের কৃষক তোতা মিয়া বলেন, লাভের আশায় হিমাগারে ১০০ বস্তা আলু রেখেছিলাম। সেই আলু বিক্রি করে হাতে এসেছে মাত্র ৩৫ হাজার টাকা। অথচ মৌসুমে বিক্রি করলে সব বাদ দিয়ে হাতে পেতাম ১ লাখ টাকা। এভাবে আলু চাষ করে আমরা এখন নিঃস্ব।
ক্ষেতলাল উপজেলার পাঠানপাড়া এলাকার জিয়াউর রহমান বলেন, আমরা যারা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে আলুচাষ করেছি, তাদের প্রতি বিঘাতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হবে। এ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছি আমরা।
জেলার কালাই পৌরসভার শিমুলতলী এলাকায় অবস্থিত আর বি কোল্ড ষ্টোরেজের আলুর পাইকার মইনুল ইসলাম বলেন, আমি প্রতিদিন আলু কিনে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করি। কিন্তু সরকার দাম নির্ধারণ করার পরও বাস্তবে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। খোলাবাজারে প্রচুর আলু রয়েছে, তাই পাইকাররা বেশি দামে আলু কিনতে আগ্রহী নন। যদি আলু রপ্তানির সুযোগ থাকত, তাহলে খোলাবাজারে চাপ কমত এবং কৃষকরাও লাভবান হতেন।
কালাই পৌরসভার সড়াইল এলাকায় অবস্থিত এম ইসরাত হিমাগারের ব্যবস্থাপক রায়হান আলম বলেন, আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে আমাদের হিমাগারগুলো থেকে আলু উত্তোলনের যে সিদ্ধান্ত দেওয়া আছে সেই অনুযায়ী এখন পর্যন্ত আলু উত্তোলন হচ্ছে না। আগামী মৌসুমের জন্য আমাদের হিমাগার প্রস্তুত করা নিয়েও চরম দুশ্চিন্তায় আছি।
কালাই উপজেলার পুনট কোল্ড ষ্টোরেজ লিমিটেডের হিসাবরক্ষক এনামুল হক বলেন, আলুর বাজার এই মৌসুমে তেমন বাড়তে পারে এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সরকার যে হিমাগার থেকে ২২ টাকা কেজি দরে আলু কেনার নির্দেশনা দিয়েছে তাতে এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
জয়পুরহাট জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, হিমাগার থেকে সরকারের বেঁধে দেওয়া ২২ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির নির্দেশনা আমরা দিয়েছি। কিন্তু হিমাগার পর্যায়ে এখনো সেই দামে আলু বিক্রি হচ্ছে না। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এখনো কোন নির্দেশনা দেন নাই। নির্দেশনা পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এফপি/রাজ