বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র আগামী ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশি পোশাকের ওপর ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের এ পদক্ষেপ কার্যকর হলে দেশের রপ্তানি, কর্মসংস্থান এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষক, উদ্যোক্তা এবং নীতিনির্ধারকরা।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ছিল প্রায় ৮৭০ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানির ৮৫ শতাংশ। এই বাজারে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে পোশাকের ওপর মোট শুল্কহার দাঁড়াবে ৫১ থেকে ৬১ শতাংশ- বিশ্বের অন্যতম প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান হুমকির মুখে পড়বে।
বড় বড় রিটেইল ব্র্যান্ড যেমন ওয়ালমার্ট, লিভাইস, এইচঅ্যান্ডএম এবং জারা ইতিমধ্যে অর্ডার স্থগিত করছে বা দেরিতে দিচ্ছে। অনেকে দাম কমানোর চাপ দিচ্ছে। প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন জানিয়েছেন, ওয়ালমার্টের জন্য ১০ লাখ পিস সাঁতারের পোশাকের অর্ডার স্থগিত করা হয়েছে। ক্ল্যাসিক ফ্যাশনের এক ই-মেইলে জানানো হয়েছে, বসন্ত মৌসুমের সব অর্ডার তারা স্থগিত করছে।
প্যাসিফিক সোয়েটার্সের ব্যবস্থাপক মো. রাশেদ জানান, “আমাদের কারখানায় ৬০ হাজার টি-শার্টের কাজ চলছিল। কিন্তু হঠাৎ অর্ডারদাতা প্রতিষ্ঠান কাজ বন্ধ করতে বলেছে। মাঝপথে উৎপাদন থামানোয় বড় আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।”
বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতির তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২০০ কোটি ডলারের রপ্তানি পণ্য ‘পাইপলাইনে’ আটকে আছে, যেগুলো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অপেক্ষায়।
বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, এ শুল্কের তালিকায় বাংলাদেশের প্রতিযোগী চীন, ভারত, ভিয়েতনাম বা পাকিস্তান নেই। এই বৈষম্যই মূলত সবচেয়ে বড় হুমকি। বিকেএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা এখন এক ডলার পর্যন্ত দর কমাতে চাপ দিচ্ছে। এটা একরকম অনৈতিক কৌশল। যেন পুরনো একচেটিয়া আচরণ আবার শুরু হয়েছে।”
বাংলাদেশ সরকার এই সংকট মোকাবেলায় জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ৯ জুলাই ওয়াশিংটনে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় অংশ নেয় বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, ৮০ শতাংশ বিষয়ে দুই দেশ একমত হলেও ২০ শতাংশ বিষয় এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু জানিয়েছেন, “চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। তবে গুঞ্জন রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত ৩৫ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করতে পারে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি থমকে যেতে পারে। ১০–১২ লাখ শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন। নতুন বিনিয়োগ থেমে যেতে পারে এবং পুরাতন প্রকল্প স্থগিত হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বাড়বে, ব্যাংক ঋণ খেলাপি বাড়বে এবং সরকারের রাজস্ব আয় কমে যেতে পারে।
ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “বড় কোম্পানিগুলো হয়তো কিছুটা মানিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এই শুল্কের চাপে টিকে থাকতে পারবে না।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকট মোকাবেলায় জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রে পেশাদার লবিস্ট নিয়োগ করে চাপ সৃষ্টি, দক্ষ টেকনিক্যাল টিম গঠন করে শুল্ক কমানোর যুক্তি উপস্থাপন, চুক্তিভিত্তিক দর কৌশল পরিবর্তন, বিকল্প বাজার অনুসন্ধান, দেশীয় ফেব্রিক উৎপাদনে বিনিয়োগ, শ্রমিক ছাঁটাই ঠেকাতে প্রণোদনা ও নীতিসহায়তা।
এই মুহূর্তে তৈরি পোশাক খাতের জন্য সময়ের দাবি হলো স্পষ্ট কূটনৈতিক কৌশল, বাস্তবভিত্তিক সমাধান এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কাঠামোর শক্তিশালী রূপান্তর। নয়তো, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত হারাতে পারে তার অবস্থান, আর লক্ষ লক্ষ শ্রমিক হারাতে পারেন তাদের জীবিকার নিরাপত্তা।
এফপি/রাজ