বাংলাদেশের রাজস্ব প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে সরকার। দীর্ঘ ৫০ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে সোমবার (১২ মে) রাতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এনবিআরের কার্যক্রম ভেঙে দুটি পৃথক বিভাগে ভাগ করা হয়েছে- ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই দুই বিভাগই হবে স্বাধীন, এবং পৃথক সচিবের নেতৃত্বে কাজ করবে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সরকার পৃথক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কার্যকর তারিখ ঘোষণা করবে। প্রশাসনিক প্রস্তুতি ও জনবল পুনর্বিন্যাস শেষে নতুন কাঠামো অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হবে।
রাজস্ব নীতি বিভাগ ও এর কার্যক্রম
‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ কর ব্যবস্থা ও নীতিমালা প্রণয়ন, আইন ও বিধি সংশোধন, গবেষণা ও আন্তর্জাতিক কর চুক্তির মতামত প্রদানসহ নীতিগত কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এর আওতায় থাকবে কর আপিল ট্রাইব্যুনাল ও কাস্টমস আপিল ট্রাইব্যুনাল।
এই বিভাগকে সহায়তার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের পরামর্শক কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছে, যেখানে থাকবেন অর্থনীতিবিদ, ট্যাক্স বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী নেতা ও সরকারি প্রতিনিধিরা।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের দায়িত্ব
‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ সরাসরি মাঠপর্যায়ে কর আদায়, প্রশাসন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও আইন প্রয়োগের কাজ করবে। এই বিভাগে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের কর, শুল্ক ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিযুক্ত হবেন।
সংস্কারের পেছনে কারণ ও লক্ষ্য
বহু বছর ধরে এনবিআরের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একই কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হওয়ায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব, তদবিরের সুযোগ এবং দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হতো বলে অভিযোগ ছিল। এক ছাতার নিচে দুই ধরনের দায়িত্বের ভারে প্রায়ই কর প্রশাসনের কার্যকারিতা ব্যাহত হতো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নীতিনির্ধারণ এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব পৃথক করা হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে। একইসঙ্গে রাজস্ব আহরণে গতি ও দক্ষতা আসবে।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ দীর্ঘদিন ধরেই এনবিআর সংস্কারের ওপর জোর দিয়ে আসছিল। নতুন অধ্যাদেশ সেই চাপ ও দেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার প্রতিফলন বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
এনবিআর বিলুপ্ত করে দুই বিভাগ চালু করায় একদিকে যেমন স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জের কথাও বলছেন প্রশাসন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দক্ষ নেতৃত্ব, আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় এবং প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন ছাড়া এই সংস্কার কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারবে না।
সাবেক এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, “একটি প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলা যতটা সহজ, নতুন দুটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সফলভাবে চালু রাখা ততটাই কঠিন।” তবে সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে এই কাঠামো রাজস্ব জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে সহায়ক হবে বলেও মত দিয়েছেন সিপিডি, টিআইবি এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষকরা।
এনবিআরের অবসান, নতুন পথচলার সূচনা
২০২৫ সালের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজস্ব প্রশাসনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। এনবিআরের অবসানের মধ্য দিয়ে শুরু হলো একটি যুগান্তকারী কাঠামোগত পরিবর্তন, যার সফলতা এখন নির্ভর করবে বাস্তবায়নের দক্ষতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।
এফপি/রাজ