গত ১৫ দিনের ঈদযাত্রায় সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে ৩৪০টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৫২ জন। আহত হয়েছেন অন্তত ৮৩৫ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু সড়কেই ঘটেছে ৩১৫টি দুর্ঘটনা, যেখানে নিহত হয়েছেন ৩২২ জন এবং আহত হয়েছেন ৮২৬ জন।
ঈদযাত্রা শুরু হয়েছিল ২৪ মার্চ থেকে এবং শেষ হয় ৭ এপ্রিল কর্মস্থলে ফেরার মাধ্যমে। এই সময়কালের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরে সংগঠনটি জানায়, গত বছরের তুলনায় এবার দুর্ঘটনা, মৃত্যু এবং আহতের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। ২০২৪ সালের ঈদে সড়কে ৩৯৯টি দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ও ১,৩৯৮ জন আহত হয়েছিলেন। সেই হিসেবে এবার দুর্ঘটনা ২১.০৫ শতাংশ, প্রাণহানি ২০.৮৮ শতাংশ এবং আহতের হার ৪০.৪১ শতাংশ কমেছে।
সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ৯ এপ্রিল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ঈদের দীর্ঘ ছুটির কারণে মানুষ ধাপে ধাপে যাত্রা করতে পেরেছে, ফলে চাপ কম ছিল এবং তুলনামূলকভাবে যাত্রাও ছিল স্বস্তিদায়ক।
সংগঠনের প্রতিবেদনে বলা হয়, মোটরসাইকেলই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল। ঈদযাত্রায় ১৩৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫১ জন প্রাণ হারান, আহত হন ১৫৫ জন। এই একাই সড়ক দুর্ঘটনার ৪২.৮৫ শতাংশ, নিহতের ৪৬.৮৯ শতাংশ এবং আহতের ১৮.৭৬ শতাংশ।
মোট দুর্ঘটনায় জড়িত যানবাহনের মধ্যে ৩২.২৭ শতাংশ ছিল মোটরসাইকেল, ১৬.৫৬ শতাংশ বাস, ১৪.৮৬ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ১৪.৪৩ শতাংশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান, ৮.০৬ শতাংশ প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস, ৭.২১ শতাংশ নছিমন-করিমন এবং ৬.৫৮ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা।
সংগঠনটির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২৭.৩০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে মুখোমুখি সংঘর্ষে, ৪২.২২ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনায়, ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়েছে। এছাড়া ১.৫৮ শতাংশ ট্রেন-যানবাহনের সংঘর্ষ, ০.৩১ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে গাড়ির চাকার সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে, এবং ৮.৫৭ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করা যায়নি।
দুর্ঘটনার অবস্থান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩৮.৪১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২১.২৬ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে এবং ৩৪.৬০ শতাংশ ফিডার রোডে ঘটেছে। ঢাকা মহানগরীতে ৩.৪৯ শতাংশ, চট্টগ্রামে ০.৬৩ শতাংশ এবং রেলক্রসিং এলাকায় ১.৫৮ শতাংশ দুর্ঘটনা হয়েছে।
দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া বা আহতদের মধ্যে ছিলেন ৭০ জন চালক, ৪৭ জন পরিবহন শ্রমিক, ৫০ জন পথচারী, ৬০ জন নারী, ৪০ জন শিশু, ৩৩ জন শিক্ষার্থী, ২০ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ৬ জন শিক্ষক, ৪ জন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং ১ জন সাংবাদিক।
রেলপথে ২১টি দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ৮ জন আহত হন। নৌপথে ৪টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১০ জন, আহত হন ১ জন, এবং নিখোঁজ রয়েছেন আরও ১ জন।
সংগঠনটি জানায়, সড়কে দুর্ঘটনার বড় কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণহীন চলাচল; রোড সাইন ও রোড মার্কিংয়ের অভাব; অন্ধ বাঁকে গাছপালা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি; সড়কের নির্মাণ ও যানবাহনের ত্রুটি; ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা; উল্টোপথে যান চলাচল; চাঁদাবাজি ও পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী পরিবহন। পাশাপাশি, অদক্ষ চালক ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে বেশি।
মোজাম্মেল হক বলেন, দুর্ঘটনা কমাতে হলে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। যেমন: মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা, মহাসড়কে পর্যাপ্ত আলোকসজ্জা নিশ্চিত করা, ডিজিটালভাবে ফিটনেস সনদ দেওয়া, দক্ষ চালক তৈরি করা এবং কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ জাকরিয়া, যুগ্ম মহাসচিব তাওহীদুল হক লিটন, অর্থ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল, প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন মাসুদসহ সংগঠনের অন্যান্য সদস্যরা।
এবারের ঈদযাত্রা তুলনামূলকভাবে কিছুটা নিরাপদ হলেও, যানবাহনের শৃঙ্খলা ফেরানো, অবকাঠামো উন্নয়ন ও জনসচেতনতা ছাড়া দুর্ঘটনার ভয়াবহতা পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব নয়- এমনটাই মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল।