বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য মাসিক খাবারের বরাদ্দ অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে জাতিসংঘ। মূলত তহবিল সংকটের কারণে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিও (ডব্লিউএফপি) সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারের বরাদ্দ অর্ধেকের বেশি কমানোর পরিকল্পনার কথা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশকে জানিয়েছে।
এমন অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আশঙ্কা করছেন, সাহায্য বন্ধের ফলে সংকট আরও গভীর হবে। এমনকি সুযোগ-সুবিধা বন্ধের ফলে তারা কোথায় যাবেন; এমন প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্বজুড়ে বেশিরভাগ বিদেশি সাহায্য বন্ধ করে দেয়ায় এবং মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএইড) ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী মানবিক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, সহায়তা বন্ধের এই পদক্ষেপ শরণার্থীদের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে।
বাংলাদেশের শিবিরগুলোতে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আশঙ্কা করছেন, সহায়তায় এই কাটছাঁটের ফলে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সমস্যা আরও জটিল হবে এবং অপরাধ বৃদ্ধি পাবে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রের মাজুনা খাতুন বলেছেন, তিনি বেশ চিন্তিত, কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু ইউরোপীয় দেশ থেকে তহবিল হ্রাসের কারণে তার ছয় মাস বয়সী শিশুটি গুরুতর স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে। ৩০ বছর বয়সী মাজুনা খাতুন বলেন, “এই সুবিধাটি বন্ধ হয়ে গেলে আমি কোথায় যাব?” এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে তার শিশুকে ক্লাবফুটের জন্য ফিজিওথেরাপি দেয়া হচ্ছে।
প্রতিবেশী মিয়ানমারের সহিংস নির্মূল অভিযানের কারণে পালিয়ে আসা বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার জেলার শিবিরে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এখানে তাদের চাকরি বা শিক্ষার সুযোগও সীমিত।
২৪ বছর বয়সী মোহাম্মদ সাদেক নামে অপর এক রোহিঙ্গা বলেন, “এখন চিকিৎসকের সংখ্যা কম। আমাদের সহায়তাকারী রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকদের বরখাস্ত করা হয়েছে। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে কারণ তারা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছে না।”
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইট অনুসারে, ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সাহায্য প্রদানকারী দেশ। রোহিঙ্গাদের সহায়তায় প্রায় ২.৪ বিলিয়ন ডলার অবদান রেখেছে দেশটি। তহবিল স্থগিত করার ফলে মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত পাঁচটি হাসপাতাল, তাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছে। শরণার্থী শিবির তত্ত্বাবধানকারী বাংলাদেশের শীর্ষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান গত মাসে এ তথ্য জানিয়েছিলেন।
ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিনা রহমান বলেন, ১১টি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রসহ প্রায় ৪৮টি কেন্দ্রে স্বাস্থ্যসেবাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে অনেক শরণার্থী প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, “আমাদের অগ্রাধিকার (এখন) সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে নারী, মেয়ে এবং শিশুদের সুরক্ষা দেয়া।”
কক্সবাজারে এনজিওগুলোর প্রচেষ্টা তদারককারী ইন্টার-সেক্টর কোঅর্ডিনেশন গ্রুপের প্রধান সমন্বয়কারী ডেভিড বাগডেন বলেছেন, স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবায় ব্যাঘাতের কারণে প্রায় ৩ লাখ শরণার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মার্কিন দূতাবাস এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য অনুরোধের জবাব দেয়নি। রয়টার্স বলছে, গুল বাহারের চার বছর বয়সী মেয়ে মুকাররামা সেরিব্রাল পালসিতে ভুগছে। গত তিন বছর ধরে তার চিকিৎসা চলছে যা তার অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করেছে। ৩২ বছর বয়সী বাহার কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “যদি এই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এখন পর্যন্ত চিকিৎসায় যা ভালো কিছু তার অর্জিত হয়েছে সবকিছু হারাব আমরা। আমি আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসব।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলছেন, সাহায্য হ্রাসের ফলে শরণার্থীরা আরও বেশি করে পাচার, মৌলবাদ এবং শোষণের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার অনুমতি না থাকার কারণে তিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।
মোহাম্মদ জুবায়ের নামে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট নেতা বলছেন, “আমাদের খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। যদি এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে এটি কেবল বাংলাদেশের জন্য সমস্যা হবে না- এটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা হয়ে উঠবে।”
এফপি/এমআই