আগে যাদের ছাপরা ছিল, তাদের আজ পাকা দালান। তিন বেলা যাদের ভাত জুটত না, সেই সব লোক বাজারে যান নাম করা ব্র্যান্ডের গাড়ি নিয়ে। চাকরি, ব্যবসা বা অন্য কোনো পরিশ্রমের আয়ে এমন পরিবর্তন হয়নি। মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অল্প সময়ের ব্যবধানেই এ অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন তারা। এসব ডিজিটাল প্রতারকেরা স্থানীয়ভাবে ‘টোপ পার্টি’র সদস্য হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার বিকাশ প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে অনেকেই। প্রতিদিন কেউ না কেউ এ ফাঁদে পা ফেলছেন। কোন একটি নাম্বার থেকে ফোন আসে গ্রাহকদের কাছে, রিসিভ করলে প্রথমে সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে শুরু। তারপর বিকাশ, অথবা নগদ একাউন্টে সমস্যার কথা বলে কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আবার অনেকে গাড়ি-বাড়ি দেওয়ার কথা বলেও হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। প্রতিদিন তারা একের পর এক টোপ দিতেই থাকে, টোপ গিললেই সাধারণ মানুষ হারাচ্ছেন সর্বস্ব। শ্রীপুর থানা পুলিশের নাকের ডগায় এসব চললেও থানা পুলিশ নির্বিকার বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
এর মধ্যে গত সোমবার (২৮ এপ্রিল) দুজনকে ৫০০পিচেরও অধিক ইয়াবাসহ গ্রেফতার করেছে শ্রীপুর থানা পুলিশ। যদিও এদের মূল হোতারা রয়েছে ধরাছোয়ার বাইরে- এমনটাই জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পুলিশ কালেভদ্রে দু-একজনকে আটক করলেও অদৃশ্য শক্তিবলে ২৪ ঘণ্টার ভেতরে তারা মুক্ত হয়ে আসেন। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন তাদের পৃষ্ঠপোষক, আর এখন বিএনপির নেতারা; সাথে কাঁচা টাকার গরম তো আছেই।
এ বিষয়ে রামনগর, বারইপাড়া, বরিশাট এবং বরিশাট নতুন পাড়ার অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিকাশ প্রতারণার পাশাপাশি এসব এলাকায় মাদকের আধিক্য বেড়েছে ভয়াবহ রূপে। বিষেশ করে ইয়াবা সহজলভ্য হওয়ায় তরুণ প্রজন্ম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এইসব ইয়াবাখোরদের ভয়ে স্থানীয়রা সবসময় নিরাপত্তা হীনতায় ভোগেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদকের হটস্পট হিসেবে বরিশাট হাইস্কুল, ঈদগাহ গোরস্থান, চারা বটতলা, নয়নশাহ ষ্ট্যান্ড, পূর্ব পাড়া প্রাইমারী স্কুলের পাশে ক্লাব এবং বরিশাট দক্ষিণ পাড়ার নাম বেশি আলোচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বরিশাট গ্রামের স্থানীয়রা জানান, বরিশাট নয়নশাহ পাড়ায় বিকাশ প্রতারক চক্রের নেতৃত্ব দেন বকুল বিশ্বাসের ছেলে ইমন ও লিমন। ওই চক্রে যুক্ত আছেন আব্দুস সত্তারের ছেলে আশিক, মিরার তিন ছেলে- জসীম, ওয়াসীম ও ইয়াছিন, বাচ্চুর দুই ছেলে রাজ্জাক ও তৌকির।
বরিশাট মোল্লা পাড়ায় বিকাশ প্রতারক চক্রের নেতৃত্ব দেন আওয়াল শেখের দুই ছেলে ফরিদ ও সেলিম। এদের চক্রে এ এলাকার সিংহভাগ তরুণ জড়িত।
বরিশাট বটতলা ও এর আশপাশে নেতৃত্ব দেন হেলাল শেখের ছেলে সিনবাদ ও আব্দুল্লাহ্। এ চক্রের সক্রিয় সদস্য দোকানদার নাসির ও তার ভাই বাবলু।
বরিশাট পূর্ব পাড়া ও এর আশপাশের নেতৃত্ব দেন মিলন (৯-নং ওয়ার্ডের নারী সদস্য ববিতার স্বামী)।
জেলা শহর থেকে বেশ দূরের হলেও এসব গ্রমে চোখে পড়ে আভিজাত্যের ছোঁয়া। চিহ্নিত বিকাশ প্রতারক ও ব্যবস্যায়ীদের আছে দেশের বাজারে পাওয়া উচ্চ মূল্যের সব নামিদামি মোটরসাইকেল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এদের বৈধ কোনো আয়ের উৎস নেই।
সন্ধার পরে গ্রামের কিছু বিকাশের দোকানে হয় অসাভাবিক লেনদেন। অনলাইন জুয়াতেও আসক্ত বেশির ভাগ তরুণ।
এলাকাবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতে এ বিষয়ে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইদ্রিস আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, পুলিশ সবসময় মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এখানে যেহেতু সামাজিক কোন্দোল বেশি- সেহেতু মাদক এবং বিকাশ প্রতারকদের দমনে একটু সময় কম পাই।
ওসি ইদ্রিস আলী আরও বলেন, বরিশাট ও মহেশপুর অনেক আগে থেকেই বিকাশ প্রতারক ও মাদক কারবারিদের জন্য স্বর্গরাজ্য। থানায় এ সংক্রান্ত চারটি মামলা রজু আছে, আমরা তাদেরকে ধরার জোড় চেষ্টা চালাচ্ছি এবং আটককৃতদের দেওয়া তথ্যমতে এ চক্রের সাথে জড়িত বাকিদেরও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।
এফপি/এমআই