জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত সমাবেশকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে সহিংসতা, সংঘর্ষ ও নিরাপত্তা সংকট অব্যাহত রয়েছে। শহরজুড়ে টানা পঞ্চম দিনের মতো কারফিউ চলছে, চলছে ১৪৪ ধারা। নিরাপত্তাবাহিনীর অভিযান ও ব্যাপক গ্রেফতারে জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। থমকে গেছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
গত ১৬ জুলাই এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা ‘লং মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে শহরে সমাবেশ আয়োজন করেন। সমাবেশ চলাকালে পৌর পার্ক এলাকায় এনসিপি কর্মীদের ওপর হামলা হয়। এর সূত্র ধরে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ এবং অগ্নিসংযোগ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই চারজন নিহত হন, পরদিন হাসপাতালে আরও একজনের মৃত্যু হয়। স্থানীয় প্রশাসন ও সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ জনে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক।
ঘটনার পরপরই গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসন পুরো জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে। এরপর সেটি কারফিউতে রূপ নেয়। কারফিউ প্রথমে আংশিক ছিল, পরবর্তীতে তা ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়। শনিবার (১৯ জুলাই) সন্ধ্যায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ কামরুজ্জামান ঘোষণা দেন, রাত ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ বহাল থাকবে। সেইসঙ্গে রবিবার সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত আবারও ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
ঘটনার পর পুলিশের কাজে বাধা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে গোপালগঞ্জ সদর, কোটালীপাড়া ও কাশিয়ানী থানায় মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় ৩ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে অন্তত ৩০৬ জনকে। অভিযোগ রয়েছে, অনেককে বিনা কারণেই আটক করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের দাবি, পুলিশ মুক্তির বিনিময়ে অর্থ দাবি করছে।
শনিবার বিকেলে সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মচারী জানান, তার ভাইকে ব্যাংক থেকে ফেরার পথে যৌথবাহিনী গ্রেফতার করে। পরে থানায় টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে।
এনজিওকর্মী, বেসরকারি চাকরিজীবী, ইন্টারনেট ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ গ্রেফতারের আতঙ্কে রয়েছেন। অনেকে এলাকা ছেড়ে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। শহরের বাসিন্দারা বলছেন, পরিস্থিতি ‘সুস্থ স্বাভাবিক’ তো দূরের কথা, ‘বন্দিশালার’ মতো হয়ে গেছে গোপালগঞ্জ।
কারফিউ শিথিলের সময় সকালে কাঁচাবাজারে ভিড় লক্ষ করা গেছে। তবে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০–৩০ টাকা পর্যন্ত। বাজারে প্রয়োজনীয় পণ্য না থাকায় অনেকেই খালি হাতে ফিরে গেছেন।
ফল ব্যবসায়ী নিতাই চন্দ্র জানান, মঙ্গলবার রাতে এক ট্রাক আম এনেছিলেন, কিন্তু বুধবারের পর বাজার বন্ধ থাকায় অর্ধেক আম নষ্ট হয়ে গেছে। সবজির আড়ত ব্যবসায়ী কালিদাস সাহা জানান, নতুন করে কোনও পণ্য আসছে না, ঘরের পুরোনো সবজি পচে গেছে। বিক্রেতারা বলছেন, চলমান কারফিউ থাকলে ব্যবসা চালানো সম্ভব হবে না।
সকাল ৬টা থেকে ১১টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকলেও অভ্যন্তরীণ রুটে যান চলাচল প্রায় বন্ধ। শহরে কিছু রিকশা ও ইজিবাইক চললেও যাত্রীসংখ্যা ছিল নগণ্য। চালকরা বলছেন, আয় হচ্ছে না, পরিবার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এদিকে টানা তিন দিন ধরে শহরের বেশিরভাগ ব্যাংকের শাখা ও বুথ বন্ধ। অনলাইন লেনদেন সচল থাকলেও এজেন্টদের ব্যালেন্স না থাকায় বিকাশ ও নগদ লেনদেন ব্যাহত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংক বন্ধ থাকায় মালামাল কেনা-বেচা আটকে গেছে, ক্ষতির পরিমাণ লাখ ছাড়িয়েছে।
গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের বহির্বিভাগে সেবা চালু থাকলেও রোগীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। অন্তঃসত্ত্বা আমেনা খানম বলেন, “চেকআপ করানো আমার জন্য এখন খুবই জরুরি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আসতে ভয় লাগছে।”
ঘটনার তদন্ত ও অভিযানের অংশ হিসেবে গোপালগঞ্জে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর যৌথ টহল চলছে। শনিবার সন্ধ্যার পর টহল আরও বাড়ানো হয়েছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে লাইট বন্ধ রাখা হয়েছে।
ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক বৃহস্পতিবার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, “ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযান চলবে যতক্ষণ না সব আসামিকে ধরা যায়।”
গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক উত্তেজনা, প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ এবং কারফিউর মতো চরম ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এফপি/রাজ